মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.): ক্ষমতাই একমাত্র লক্ষ্য, বাকি সব উপলক্ষ। তাই বাংলাদেশের রাজনীতি বলতে বোঝায় শুধু নির্বাচন, এর বাইরে কিছু নেই। সুতরাং ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এখনই রাজনীতির মাঠ গরম হতে শুরু করেছে। জাতীয় সংসদে সদ্য গৃহীত এবং ইতোমধ্যেই গেজেট আকারে প্রকাশিত নির্বাচন কমিশন আইন ও কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে চলছে পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনা-সমালোচনা। এটা যত বেশি হবে ততই ভালো। কিন্তু দেশের কোনো নাগরিক বা পক্ষ কি বলতে পারে আইন মানি না। সমস্যাটা এখানে। আইন যদি সংবিধানসম্মত হয় তাহলে সেই আইন সবাই মানতে বাধ্য। আর আইন যদি সংবিধানসম্মত না হয় তাহলে তারও প্রতিকার আছে। বাহাত্তরের সংবিধানে উল্লিখিত বিধান ৫০ বছরে কেউ বাস্তবায়ন করেনি। এবার সেটা হলো জনদাবি ও জনআকাক্সক্ষা উপলব্ধি করতে পারাটা রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এই পদক্ষেপটি গণতন্ত্র অগ্রায়ণের পথে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ আইনটি আরও এক-দুই বছর আগে হলে আরও ভালো হতো, সরকারের সদিচ্ছা মানুষ বুঝতে পারত। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ফরোয়ার্ড লুকিং না হলে এমনটাই হয়।
যা কিছু হয় তার জন্য সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা পূরণ হয়েছে, এটা কম কথা নয়। আইন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এরকম আইন না থাকা সত্ত্বেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে। সালিশ মানি তাল গাছ আমার, এই ধ্যান ধারণা থেকে রাজনীতিক দলগুলো সরে আসতে না পারলে সবকিছু যেমন ছিল তেমনই থাকবে। সব গণতান্ত্রিক দেশে সুশীল সমাজের একটা মর্যাদাশীল ভূমিকা থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজে সুপরিচিত কিছু সার্বক্ষণিক সরব নিরপেক্ষ যারা রয়েছেন, তাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তার উদ্দেশ বোঝা মুশকিল। এই বললেন সরকার ইচ্ছা করলে তিন দিনের মধ্যে আইন করতে পারে। আবার এখন বলছেন, এত তাড়াহুড়ো করে আইন করা হয়েছে, এর উদ্দেশ ভালো নয়। বলছেন, কমিশনে কারা নিযুক্তি পাবেন তার জন্য গণশুনানি করতে হবে। গণশুনানির কাঠামো ও বিস্তৃতি, গণ বলতে কাদের বোঝাবে এবং এই গণদের সংখ্যা কত হবে, এদের তালিকা করবে কে অথবা কারা। এসব প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। সুতরাং উদ্দেশ্য ভালো নয়। সবকিছু ল-ভ- করতে পারলে আবার ১/১১-এর প্রেক্ষাপট তৈরি হবে। তখন সবাই হবেন খারাপ, শুধু ওই সংজ্ঞাহীন নিরপেক্ষরাই হবেন সাধু। ১/১১-এর পরিণতিতে দেশের মহাসর্বনাশ হয়েছে। তবে সেই সূত্রে বড় ভালো একটি কাজও হয়েছে। ২০০৭-২০০৮ মেয়াদে নিরপেক্ষ সম্মানীয়দের সবাইকে মানুষ চিনতে পেরেছেন এবং তাদের বৈশিষ্ট্যও দেখেছেন। এনারা সবাই ১/১১ সরকারে শুধু পূর্ণ সমর্থক নয়, মেন্টর, ফিলোসোফার ও গাইড ছিলেন। সেই সরকারের কর্তারা বিগ ব্যাঙের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন দেশের সবকিছু তারা শতভাগ ঠিক করে দিবেন। লক্ষ-কোটি ঝাড়ু দিয়ে সব সাফ করে ফেলবেন। চারদিকে করতালির ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি সপ্ত আকাশ ভেদিয়া সপ্তস্বরা হয়ে সেটি স্বয়ং ইন্দ্রর কাছে পৌঁছে গেল। নিরপেক্ষ দলের এক সেনাপতি ইন্দ্রর কাছে আর্জি জানালেন, বাংলাদেশের যা অবস্থা তাতে সবকিছু করতে হলে অন্তত ১০ বছর সময় তাকে দিতে হবে। ইন্দ্রর বিরক্তিকর মুড দেখে সেনাপতি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, প্রভু চিন্তা করবেন না। কিছু রাজকীয় দল থাকবে, টানা দশ কী, বিশ বছর ক্ষমতায় থাকলেও তারা আমাদের গুণগান গাইবে। কিন্তু ইন্দ্র দাবি প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, এত সময় দেওয়া যাবে না। দ্রুত সব কাজ শেষ করতে হবে। সুতরাং দ্রুত কাজ সারতে তারা সবাই মাঠে নেমে পড়লেন। তারপরে যা ঘটল তার প্রত্যক্ষদর্শী আমরা সবাই। রবি ঠাকুরের জুতা আবিষ্কারের মতো অবস্থা। ‘করিতে ধুলা দূর/জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর’। আমাদের এক মহান নেত্রী তখন একবার আদালতে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘পরগাছা ও দালাল দিয়ে দেশ চলে না’। একদম যথার্থ কথা। মহান নেত্রীর সেই ঘোষণায় নির্দেশিত পরগাছা ও দালালরা আবার সক্রিয়। দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের উন্নতি সমৃদ্ধির বিনিময়ে হলেও তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চান। পদ্মা সেতু যাতে না হয় সে জন্য তারা রাতদিন কাজ করেন। অর্থ ছাড় এবং খরচ কোনোটাই হলো না, অথচ প্রমাণ ছাড়া ভিত্তিহীনভাবে পত্রিকায় টেলিভিশনে তারা চিৎকার করে বলতে থাকলেন, ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু কানাডার ফেডারেল আদালত যখন রায় দিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি; তখন তারা একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। পদ্মা সেতু নিয়ে তাদের ভূমিকাতেই স্পষ্ট হয় আসলে তারা কী চান। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন যেভাবে হওয়া উচিত ছিল সেভাবে হয়নি, এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু তারা এমনভাবে সবকিছু উত্থাপন করেন তাতে মনে হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বাহাত্তরের সংবিধান এবং ২৩ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি মূল্যবোধকে একটি বড় রাজনৈতিক পক্ষ স্বীকার করে না। এ সম্পর্কে তাদের কোনো কথা বলতে শোনা যায় না। রাষ্ট্র ও রাজনীতির এই মৌলিক বিভাজন অটুট রেখে কি সুষ্ঠু ও সঠিক নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, ১৩ কেন্দ্রে বিএনপি এবং দুই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ শূন্য ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ ২২৮টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। এ তথ্যগুলোই তারা বারবার উল্লেখ করেন। এর থেকে বড় অনিয়মের প্রমাণ থাকলে নিশ্চয়ই সেটাও তারা উল্লেখ করতেন। মোট ভোট কেন্দ্র ছিল ৪০ হাজারের ঊর্ধ্বে। তাতে শতকরা হিসাবে মাত্র ০.৫৬ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। শতকরা এক ভাগের কম ভোট কেন্দ্রে অনিয়মের কারণে কি পুরো নির্বাচনটিকে অগ্রহণযোগ্য বলা যায়। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জন্য নির্বাচনে হেরে যাওয়াটা কি খুবই অস্বাভাবিক বিষয়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত শাসন ব্যবস্থার ভয়ংকর ও করুণ চিত্র মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যাওয়ার নয়। দেশকে হিন্দুশূন্য করার কর্মকান্ড থেকে শুরু করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ ধর্মান্ধ সশস্ত্র জঙ্গিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। বিশ্বের বড় বড় মিডিয়া হাউস ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তখন বলতে থাকে পরবর্তী আফগানিস্তান হবে বাংলাদেশ। বিশ্ব অঙ্গনে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। পাঁচ বছরে জামায়াত-বিএনপি সরকার এক মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করতে পারেনি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের সবগুলো সূচকের অবস্থান তলানিতে পড়ে থাকে। সুতরাং ২০০৯ সাল থেকে টানা ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যের বিবেচনায় দলীয় নির্দিষ্ট ভোটের বাইরে সাধারণ মানুষের ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা তো ছিল না। কিন্তু মৌলিক সমস্যা হলো ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা অথবা শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিকল্প, এই জায়গায় অন্য কোনো দল তো নেই। তাই গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার রাজনীতি অপরিহার্য। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপি বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতির সর্বনাশ করেছে তাই শুধু নয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিএনপির হাতে কতটুকু নিরাপদ সেই প্রশ্নটি প্রবল আকারে উঠেছে। আঞ্চলিক শক্তি বলয়ও বিএনপির ওই ভূমিকায় শঙ্কিত হয়ে আছে। এখনো সময় আছে, বিএনপি শুদ্ধ রাজনীতিতে ফিরে এলে সবার জন্য মঙ্গল হয়। সুতরাং বিএনপি যদি সত্যিকারার্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধের জায়গায় ফিরে আসে তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির মৌলিক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৩ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হচ্ছে, প্রায় দেড় দশক আগের ব্যর্থ কৌশলের ধ্বংসাত্মক পথের দিকে হাঁটছে তারা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বয়কট ও ভায়োলেন্সের পথে গিয়ে বিএনপির ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হয়নি। আবার সেই ব্যর্থ পথ ও কৌশলের কথা শুনে মনে হয় গত দেড়-দুই দশকের রাজনীতি থেকে বিএনপি কোনো শিক্ষা নেয়নি। আগের মতোই চলমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির বাস্তবতার সঙ্গে তাল মেলাতেও তারা ব্যর্থ হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্ম ও মৃত্যু দুটোই বিএনপির কারণে হয়েছে।
১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদে বিএনপি যদি মাগুরা ও মিরপুরের উপ-নির্বাচনে জেতার জন্য মরিয়া আচরণ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাদেক আলী মার্কা নির্বাচন না করত তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি গ্রহণযোগ্যতা পেত না। ১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান লতিফুর রহমান শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ওই রাতেই বাকি উপদেষ্টাদের নিয়োগের আগে ১১ সচিবকে পদচ্যুত, সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার সব টেলিফোন বিচ্ছিন্ন এবং সারা দেশে বিএনপির কর্মীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করলেও লতিফুর রহমান নিশ্চুপ থাকেন। এটা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মারার দ্বিতীয় ডোজ, প্রথমটি প্রয়োগ করেছেন বিএনপি কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯৬ সালের মে মাসে সেনাবাহিনীকে বিতর্কে জড়িয়ে। একজন প্রধান বিচারপতিকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার টার্গেট করে শুধু বিচারপতিদের চাকরির বয়স দুই বছর বৃদ্ধি করার মাধ্যমে তৃতীয় ডোজটি প্রয়োগ করেন ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপির আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার মাধ্যমে চতুর্থ মৃত্যু ডোজটি প্রয়োগ করেন। সর্বশেষ ডোজটিও প্রয়োগ করেন ইয়াজউদ্দিন আহমদ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি এবং নিজেকে নিজে বাতিলের মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালের জন্য নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ইতোমধ্যে মৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি কবরস্থ হয়। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভায়োলেন্স নয়, সুস্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চাইলে বিএনপিকে মেধা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিতে হবে। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতায় বলে মৃত ঘোড়াকে পিটিয়ে জীবিত করা যায় না।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। সূূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন